স্টিভেন হকিং (৮ জানুয়ারি, ১৯৪২ – ১৪ মার্চ ২০১৮)

স্টিভেন উইলিয়াম হকিং, সিএইচ, সিবিই, এফআরএস, পিএইচডি (ইংরেজি: Stephen William Hawking; ৮ জানুয়ারি, ১৯৪২ – ১৪ মার্চ ২০১৮) বিশিষ্ট ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁকে বিশ্বের সমকালীন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম গণ্য করা হয়। হকিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল কসমোলজির গবেষণা প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসীয় অধ্যাপক ছিলেন এবং ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর এই পদ থেকে অবসর নেন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিল ও কেইয়ুস কলেজের ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন।

পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দুইটি অবদান সর্বত্র স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব কৃষ্ণ বিবর-এর ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে কৃষ্ণ বিবর থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ (অথবা কখনো কখনো বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ) নামে অভিহিত। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিক্যাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন এবং ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, খেতাবে ভূষিত হন। ২০০২ সালে বিবিসির “সেরা ১০০ ব্রিটন্‌স” জরিপে তিনি ২৫তম স্থান অধিকার করেন। তাঁর নিজের তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে রচিত বই কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (আ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম) দিয়ে তিনি বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করেন এবং বইটি রেকর্ড ভঙ্গ করা ২৩৭ সপ্তাহ ব্রিটিশ সানডে টাইমসের সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকায় ছিল।

শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল এবং এমায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস বা লাউ গেহরিগ নামক একপ্রকার মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হন, তবুও বহু বছর যাবৎ তিনি তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যান। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার পরও তিনি এক ধরনের শব্দ-উৎপাদনকারী যন্ত্রের সাহায্যে অপরের সাথে যোগাযোগ করতেন। তিনি ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

 

জন্ম ও পরিবার

গ্যালিলিও গ্যালিলাই-এর মৃত্যুর ঠিক তিনশত বছর পরে, ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি স্টিভেন হকিংয়ের জন্ম,অক্সফোর্ডে। হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং (১৯০৫-১৯৮৬) একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং (জন্মনাম: ওয়াকার, ১৯১৫-২০১৩) একজন রাজনৈতিক কর্মী। তার মা ছিলেন স্কটিশ।হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন। লন্ডনে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, তখন একটি চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তার মা-বাবার পরিচয় হয়, সেখানে ইসোবেল মেডিক্যাল সহকারী হিসেবে এবং ফ্রাঙ্ক চিকিৎসা গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান।হকিংয়ের জন্মের পর তাঁরা আবার লল্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন রয়েছে। এছাড়া হকিং পরিবারে এডওয়ার্ড নামে এক পালকপুত্রও ছিল।

হকিংয়ের বাবা-মা পূর্ব লন্ডনে বসাবস করলেও ইসোবেল গর্ভবতী থাকার সময় তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। সে সময় জার্মানরা নিয়মিতভাবে লন্ডনে বোমাবর্ষণ করতো। হকিংয়ের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে তাদের বসতবাড়ির কয়েকটি গলি পরেই জার্মানির ভি-২ মিসাইল আঘাত হানে। স্টিভেনের জন্মের পর তাঁরা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। সেখানে স্টিভেনের বাবা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।

 

শিক্ষা

হকিং হার্টফোর্ডশায়ারের র‍্যাডলেট গ্রামের স্বাধীন স্কুল, র‍্যাডলেট স্কুলে, এক বছর পড়াশুনা করেন, এবং ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবান্‌সের অপর একটি স্বাধীন স্কুল, সেন্ট অ্যালবান্‌স স্কুলে, পড়াশুনা করেন। হকিংয়ের পরিবার শিক্ষায় গুরুত্ব দিতো। হকিংয়ের বাবা চেয়েছিলেন তার পুত্র প্রখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে পড়াশুনা করুক, কিন্তু ১৩ বছর বয়সী হকিং বৃত্তি পরীক্ষার দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। বৃত্তি ছাড়া তাঁর পরিবার ওয়েস্টমিনস্টারে তাঁর পড়াশুনার খরচ চালাতে পারবে না, তাই তিনি সেন্ট অ্যালবান্‌সে রয়ে যান। এর একটি ইতিবাচক দিক ছিল হকিং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে রয়ে যান এবং বোর্ড গেম খেলতেন, আতশবাজি প্রস্তুত করতেন, উড়োজাহাজ ও নৌকার মডেল তৈরি করতেন, এবং খ্রিস্টান ধর্ম ও ইন্দ্রিয় বহির্ভূত অনুভূতি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতেন। স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে গণিত শিক্ষক ডিকরান তাহতার অনুপ্রেরণার কথা হকিং পরবর্তী জীবনে স্মরণ করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে তাহতার সাহায্যে তারা ঘড়ির অংশবিশেষ, পুরনো টেলিফোনের সুইচবোর্ড, ও অন্যান্য রিসাইকেল করার উপাদান দিয়ে কম্পিউটার তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে হকিং স্কুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বজায় রাখেন। নিজের নামে স্কুলের চারটি হাউসের একটি ও সহপাঠের লেকচার সিরিজের নাম দেন। স্কুল ম্যাগাজিন “দি অ্যালবানিয়ান”-এ দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন।

স্কুলে তিনি “আইনস্টাইন” নামে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু শুরুর দিকে তাঁর পরীক্ষার ফলাফল তেমন ভালো ছিল না।বিজ্ঞানে হকিংয়ের সহজাত আগ্রহ ছিল। হকিং তাঁর শিক্ষক তাহতার অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন।হকিংয়ের বাবার ইচ্ছে ছিল হকিং যেন তার মতো ডাক্তার হয়, কারণ গণিতে স্নাতকদের জন্য খুব বেশি চাকরির সুযোগ ছিল না।এছাড়া তাঁর পিতা তার নিজের কলেজ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি করাতে চান, কিন্তু যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয় নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর শিক্ষক তাঁকে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ১৯৫৯ সালের মার্চে পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি লাভ করেন।সে সময়ে তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।

 

কর্মজীবন

 ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত স্টিভেন হকিং তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ১৯৬০ এর দশকে ক্যামব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন।সেই মডেলের উপর ভিত্তি করে ১৯৭০ এর দশকে হকিং প্রথম তাঁদের (পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব নামে পরিচিত) তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন। এই তত্ত্বগুলো প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্বের পর্যাপ্ত শর্তসমূহ পূরণ করে। আগে যেমনটি ভাবা হতো এককত্ব কেবল একটি গাণিতিক বিষয়। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল, এককত্বের বীজ লুকোনো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে।

১৯৭৪ সালে হকিং রয়্যাল সোসাইটির অন্যতম কনিষ্ঠ ফেলো নির্বাচিত হন।

মৃত্যু

হকিং ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ কেমব্রিজে তাঁর বাড়িতে মারা যান। তাঁর সন্তানরা তাদের দুঃখ প্রকাশ করে এই মর্মে একটি বিবৃতি জারি করেছে।

Loading

Comments

So empty here ... leave a comment!

Leave a Reply

Sidebar